৭ই মার্চের ভাষণ : অজানা অধ্যায়

0
157

ড. মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী: রাজনীতির কবি তাঁর ১৮ মিনিটের অমর কবিতা ৭ই মার্চের ভাষণে ‘আমি’ ‘আমরা’ এবং ‘আমাকে’ এই তিন শব্দমালা প্রায় ৪৪ বার উচ্চারণ করেন। নজরুল যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লেখার কারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘বিদ্রোহী কবি’ উপাধি প্রদান করেন, সে কবিতায় ‘আমি’ শব্দটি উল্লেখ করেন ১৪৪ বার। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাড়া আর কোথাও ‘আমি’ শব্দটি এত বেশী উচ্চারিত হয়েছে কিনা বলা মুশকিল। এই দুই কৃর্তিমানের ‘আমি’ শব্দটি ব্যক্তিগত অহংবোধের নয়, জাতি শক্তির বিকাশ ও গৌরবের। যে অহংকার ছোট করে না বড় করে। যেমন একুশ আমার অহংকার। আমার স্বাধীনতা আমার অহংকার। ৭ই মার্চের ভাষণের লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের নয়। বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ত্যাগ করলে পাকিস্তানিরা তাঁর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি ছিলো। তিনি অনায়াসে হতে পারতেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান। ক্ষমতার পরিবর্তে বাংলার মানুষের অধিকার ও মুক্তিই ছিলো তাঁর মূল লক্ষ্য। এই ভাষণে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের অধিকার চাই’। তাঁর নিকট প্রধানমন্ত্রিত্বের চেয়ে অধিকার বড় আর স্বাধীনতার চেয়ে মুক্তি বড়।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। তিনি বাঙালির অধিকারের কথা বলতে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্টতার ক্ষমতা প্রদর্শন করেননি। আমরা দেখতে পাই, গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্টতার শক্তি প্রয়োগে অনেক ভালো চিন্তা ও উদ্যােগ বাতিল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু সংখ্যাগরিষ্টতার শক্তি প্রয়োগ করে কোনো দাবি আদায় করতে চাননি। ন্যায্য বিচার চেয়ে বলছেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব’।
সুভাষ বসু বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। বঙ্গবন্ধু বাঙালির রক্ত চাওয়ার আগেই স্বাধিকারের আন্দোলন হতে রক্ত দিতে শুরু করে। তাই তিনি ৭ই মার্চের ভাষণে বলছেন,’রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব; এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো’। সাথে সাথে তিনি ‘ইনশাল্লাহ’ বলেছিলেন।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো কাজে ‘ইনশাল্লাহ’ বললে সেটি আল্লাহ কবুল করেন’।
মহান আল্লাহ পাক বঙ্গবন্ধুকে কবুল করেছিলেন বলেই তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন।
এই ভাষণে তিনি আরো ঘোষণা করেন,’আমরা যখন রক্ত দিতে শিখেছি, কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’। সুভাষ বসুর বাঙালির চেয়ে বঙ্গবন্ধুর বাঙালি এখানে অগ্রসর।
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ছিলো হ্যামিলনের বংশী। যে বাঁশির সূরে মাতোয়ারা হয়ে মানুষ তাঁর পিছনে ছুটে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে।
তিনি সাড়ে সাত কোটি জনতাকে রক্ত দেওয়ার হুকুম দিয়ে আত্মগোপন বা পালিয়ে যাননি; নিজেও রক্ত দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসেছিলেন। গ্রেফতারের পর তাঁর ফাঁসির হুকুম হয়। তাতে তিনি সামান্যতম বিচলিত হননি। এমন সাহসী নেতা দুনিয়াতে মেলা কঠিন।
মহাত্মা গান্ধী চেয়েছিলেন অখণ্ড ভারত। জিন্না ছিলেন ভারত ভাগের পক্ষে। তাঁর স্বপ্ন ছিল অবৈজ্ঞানিক পাকিস্তান। ভারতের জাতির জনক যা চেয়েছিলেন তা হয়নি। জিন্নার পাকিস্তান ২৩ বছরে ভেঙে গেলো। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তান চাইলেন তখন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।আর যখন বাংলাদেশ চাইলেন তখন স্বাধীন বাংলার জন্ম হয়। মহাত্মা-জিন্নার স্বপ্ন পূর্ণ না হলেও বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন অপূর্ণ থাকেনি।বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ ৫০ বছর পরও ঠিকে আছে, ইনশাআল্লাহ অনন্তকাল ঠিকে থাকবে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার সময় কারো কোনো কথার দাম ছিলো না, তাঁর কথাই শেষ কথা। তাঁর কথাই বাংলার আইন। তিনি ৭ই মার্চের ভাষণে যা বলেছিলেন, তা জনগণ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। তখন তিনি ছিলেন ১২ শ’ মাইল দূরে কিন্তু তাঁর ভাষণে দিয়ে যাওয়া নির্দেশনায় সৃষ্টি হয় একটি জাতি রাষ্ট্রের। এই ভাষণ নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্রে পরিণত করেন। শহীদ হন ৩০ লক্ষ মানুষ। সম্ভ্রম হারান ২ লক্ষ মা বোন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ২১ বছর এই ভাষণ বাজানো ও সম্প্রচার ছিলো নিষিদ্ধ। এই ভাষণ বাজাতে গিয়ে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা পঙ্গু হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে। জেল জুলুম নির্যাতন ভোগ কম করেনি। তখন আমরা বলেছিলাম, এই ভাষণ আমাদের জাতীয় সম্পদ। ৪৬ বছর পর দুনিয়ার সেরা সংস্থা জাতি সংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষণা করলেন, এটি জাতীয় সম্পদ নয়, সমগ্র পৃথিবীর সম্পদ। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। জামাত- বিএনপি এই ভাষণের গুরুত্ব বুঝবে কী করে! যেখানে পৃথিবীর সেরা সংস্থা ইউনেস্কোর এই অসাধারণ ভাষণটির গুরুত্ব বুঝতে ৪৬ বছর সময় লেগেছে। যারা এই ভাষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল তারা আজ ইতিহাসে কলঙ্কিত।
৭ই মার্চের ভাষণ যদি পৃথিবীর সম্পদ হয়,যিনি এই ভাষণ প্রদান করেন তিনি কী বিশ্বের সম্পদ বা বিশ্বনেতা নয়? বিএনপি জামাত এই বিশ্বনেতাকে ৫০ বছর ধরে অপমান করে আসছে। তারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছে। এসব রাষ্ট্রদ্রোহীতা। বিরোধীতা করতে গিয়ে তারা রাষ্ট্র ও দলকে এক করে ফেলে। যে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু এই ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন, সে স্থানে ১০ জানুয়ারি (১৯৭২) তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। সেই ঐতিহাসিক ময়দানেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে এবং এই ময়দানে মুজিব-ইন্দিরা যুক্ত ভাবে জনসভায় ভাষণ দেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখন করে এই ঐতিহাসিক ময়দানের স্মৃতি চিহ্ন মুছে দিতে শিশু পার্ক প্রতিষ্ঠা করে। আর এই ময়দান মেপে ঠিক যে স্থানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন সে স্থানেই মলমূত্রত্যাগ করার জন্য স্থাপন করে পাবলিক টয়লেট। এখনে আমি মন্তব্য নিস্প্রয়োজন মনে করছি।
বিশ্বের অনেক নেতা আছে যারা একটি ভাষণের জন্য মহাকালে অমর হয়ে আছে। আবার কেউ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারণে বিশ্বে খ্যাতিমান হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু একমাত্র নেতা যিনি শুধু সেরা ভাষণ দেননি, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রেরও জন্ম দিয়েছেন। যে ভাষণ পৃথিবীর সম্পদ এবং স্বাধীনতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে,সে ভাষণটি এখনো কেন পাঠ্যপুস্তুকের অন্তর্ভুক্ত হলো না তা চিন্তার বিষয়।
মনীষারা বলেগেছেন,প্রকৃত নেতা সেই যে সময়ের সাথে সাথে বড় হন। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ভাষণ সময়ের সাথে সাথে নতুন ভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে, হবে। ইতিহাসের পাতা ছেঁড়া যায়, মুছা যায় না।

ড. মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী : লেখক, কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ