সবুজপত্রের স্থপতি প্রমথ চৌধুরী

0
535

বাংলা সাহিত্যের নতুনত্ব যাদের হাত ধরে এসেছে তাদের ভেতর অন্যতম প্রমথ চৌধুরী। তিনি বাংলা সাহিত্যকে সাধুরীতি থেকে চলিতরীতিতে প্রবর্তন করেছেন। তিনি ছিলেন সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক। যার সমালোচনা ব্যক্তি নির্ভর ছিল না, ছিল সাহিত্য নির্ভর। তিনি বাংলা সাহিত্যে বীরবল নামেই বেশি পরিচিত। তিনি বিখ্যাত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং তা কৃতিত্বের সাথে পালন করেন। বাংলা সাহিত্যকে তিনি নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন।

প্রমথ চোধুরী ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার মাধ্যমে নতুন লেখকদের একটি শক্তিশালী সংঘ তৈরি করেছিলেন। তার রচনা শিল্পগুণ ছিল অসাধারণ। তিনি যেমন ব্যঙ্গাত্বক রচনা করতে পারতেন তেমনি তার কবিতাগুলো খুবই বাস্তববাদী এবং রূঢ়। তার কবিতা ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ যেমনটি তার ছোটগল্পগুলোতেও লক্ষ করা যায়। তিনি তার ছোট গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন বিষয় ভিত্তিক ভাবধারা। ভাষার ব্যবহারে রেখেছেন সৃষ্টিশীলতা।

ছোটগল্পের মতো করে তার প্রবন্ধগুলোতেও দেখতে পাই আমরা বিভিন্ন ধারা। প্রবন্ধগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা প্রধান তিনটি ধারা পাই; বিষয়ভিত্তিক বৈচিত্র, গভীর চিন্তাশীল ও ভাষা ব্যবহারের মধ্যে নিটোল প্রকাশভঙ্গী। যখন কোন লেখক কোন কিছু লিখেন প্রথমে একটা বিষয় অবলম্বন করে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন। তারপর মিশ্রণ করেন ব্যক্তিগত অনুভূতি ও চিন্তার রসবোধ। রূপান্তরিত করেন নিজস্ব ঢংয়ে অথবা ভাবকল্পনায়। পরিণত করেন উপযুক্ত আঙ্গিকে। প্রতিটি রচনায় থাকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। আমরা প্রমথ চৌধুরীর গদ্য সাহিত্যের তিনটি উপাদান স্বল্প পরিসরে আলোচনা করলে দেখতে পাব- দেশ, সমাজ, যুগ, সাহিত্য, দর্শন, সঙ্গীত, ভাষা প্রভৃতির কোন দিকেই তার আগ্রহের কমতি ছিল না।

প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধগুলো বিচিত্র বিষয়াবলম্বনে রচিত। প্রত্নতত্ত্ব থেকে সমসাময়িক রাজনীতি পর্যন্ত এমন কোন বিষয় নেই যা তার প্রবন্ধে স্থান পায়নি। তবে সাহিত্য সম্পর্কিত প্রবন্ধের পরিধিই বেশি । বিষয়ের বিন্যাস এবং বক্তব্যকে পরিস্ফুট করে তোলার জন্য তিনি পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করেছেন। বহু জ্ঞান সাধনা এবং মনের অন্তর্ভেদী রূপ বিশ্লেষণই তার জীবনের প্রধান নেশা ছিল। তার বিষয়বস্তুর মধ্যে যেমন নতুনত্ব আছে, তেমনি বলার ভঙ্গিতেও আছে নতুনত্বের ইঙ্গিত। ‘সবুজপত্র’ প্রাণশক্তিহীন অকাল বার্ধক্যের দেশে সবুজ যৌবনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। চিরন্তন যৌবন ও অফুরন্ত প্রাণধর্মের বন্দনা করেছেন। তেমনি তার চিন্তাশীলতার প্রকাশ ছিল সম্পূর্ণ মৌলিক। পরিচিত বিষয়বস্তুকে নিয়ে তিনি গভীর যুক্তি ও শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে পরিবেশন করেছেন যা পাঠকের কাছে একদম নতুন। সাধারণ বিষয় উপাদান তার স্বচ্ছ ও নিটোল চিন্তাশীলতার মাধ্যমে একটি ভিন্ন পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছে। তার প্রকাশভঙ্গিতে ভাষার ব্যবহার, শব্দ নির্বাচন, অলঙ্কার সৃষ্টি এবং উপস্থাপন কৌশ অসাধারণ ছিল।

প্রমথ সাহিত্যে গদ্যের প্রকাশভঙ্গী বিবেচনায় আরও কিছু বিষয় আমরা দেখতে পাই। এগুলো হল- ভাষা, বাকচাতুর্য, পরিহাসপ্রিয়তা, অলংকার সৃষ্টি, এপিগ্রাম সৃষ্টি, প্যারাডক্স, প্রবচনের সুষম প্রয়োগ এবং উপস্থাপন কৌশল।

প্রমথ চৌধুরী কৌশলবাদী সাহিত্যিক ছিলেন। তার মতে শিক্ষার কাজ মানুষের মনকে বিশ্বের খবর জানানো, আর সাহিত্যের কাজ মানুষের মনকে জাগানো। সাহিত্য আনন্দ দেয়। এ আনন্দ নিটোল, কারও মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য আদর্শচ্যুত হয়। তিনি বাঙালি মনকে জাগাতে চেয়েছিলেন, রেনেসাসের আধুনিক মুল্যবোধ চেতনাকে আত্মস্থ করে বাংলা সাহিত্য ও সমাজ চেতনায় এর সংযোজন করতে চেয়েছেন এবং তাতে তিনি পরিপূর্ণভাবে সফল হয়েছেন।