ভদন্ত দীপানন্দ স্থবির (বিএমবিএ)’র রিভিউ কেন্দ্রীয় ট্রাস্টি বোডের সদস্যপদ লাভ

0
127

অনেক মহান সাধক মহাপুরুষের জন্ম জনপদ খ্যাত পূর্ণভূমি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধপল্লী কানাইমাদারী গ্রামের স্বনামধন্য পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা অনিল বড়ুয়া ও মাতা প্রয়াতা মঞ্জুরাণী বড়ুয়ার গৃহ আলো করে ১৯৮৩ ইং সালের ৫ ফেব্রুয়ারী তাদের দ্বিতীয় পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। তার নাম রাখা হয় সিন্টু বড়ুয়া। ৩ ভাই ৫ বোনের মধ্যে সিন্টু বড়ুয়া দ্বিতীয় সন্তান। বাল্য কালে দুরন্ত ও চঞ্চল প্রকৃতির হলেও র্ধম প্রতি ছিল খুবই অনুরাগী,নিয়মিত বিহারের পরিচর্যা ও ফুল, প্রদীপ দিয়ে বন্দনা করতেন। কালের পরিক্রমায় কর্মের অধীন অনিত্য এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। জমজ কন্যা সন্তান প্রসবের ২১ দিন পর তার গর্ভধারনী মাতা মঞ্জু রাণী বড়ুয়া পরলোক গমন করেন। মাতার মৃত্যুর পর বিমাতা লাকী বড়ুয়া সন্তান স্নেহে তাকে লালন পালন করেন। চামুদরিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর চামুদিয়া ইউনাইটেড ইনষ্টিটিউট মাল্টিলেটার হাইস্কুলে তার মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু হয়। অষ্টম শ্রেণি হতে উর্ত্তীণ হওয়ার পর অনেকটা অনাকাংখিত ভাবে শ্রামন্য র্ধমে দীক্ষা লাভ করেন। ২০০০ইং সালে ২০ জানুয়ারী কানাইমাদারী গ্রামের দানশীল ব্যক্তিত্ব লায়ন অমূল্য রঞ্জন বড়ুয়ার বাড়ীতে অষ্ট উপকরণসহ সংঘদান উপলক্ষে তার আগের দিন উনার ভাগিনা ও তার দুই জ্ঞাতি অত্র গ্রামের র্ধমপ্রাণ উপাসক বাবু অনিল বড়ুয়াসহ চার বৌদ্ধ কুলপুত্রকে প্রবজ্যা প্রদান করার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ অনিল বড়ুয়ার স্ত্রী অসুস্থ্যতা জনিত কারণে প্রবজ্যা গ্রহণে অসমর্থ হলে আত্মীয় জ্ঞাতিস্বজন ও গ্রামবাসী সকলে তার দ্বিতীয় পুত্র বালক সিন্টু বড়ুয়াকে প্রবজ্যা গ্রহণের প্রস্তাব করলে, সানন্দে প্রবজ্যা র্ধম গ্রহণে সম্মত হয়। তার আচরিত গুরু ছিলেন, কানাইমাদারী বিদর্শনারামের অধ্যক্ষ উদয়ন জ্যোতি মহাস্থবির এবং শ্রামণ্যর্ধমে দীক্ষিত করেন। বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার দ্বাদশতম সংঘরাজ ঊনাইনপুরা লংকারাম অধিপতি ড.শ্রীমৎ ধর্মসেন মহাস্থবির এ সময় তার নাম রাখা হয় দীপানন্দন শ্রমণ। শ্রমণ অবস্থায় শীলের বিশুদ্ধতা রক্ষায় খুবই যতœবান ছিলেন এবং বিদর্শন ভাবনার প্রতি তার খুবই আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। তারই অংশ হিসাবে শ্রমণ অবস্থায় কানাইমাদারী বিদর্শনারামে আশীন কেমিকার বিদর্শন ভাবনাকোর্সে অংশগ্রহণ করেন। বিদর্শনাচার্য প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরর পরিচালনায় ভাবনাকোর্সে অংশ গ্রহণ ও মায়ানমার হতে বিশেষ ভাবে বিদর্শন ভাবনায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বিদর্শন সাধক প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরর তত্ত্বাবধানে ধ্যান অনুশীলন করেছেন। শ্রমণ অবস্থায় দশম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যায়ন করে তাঁর সাধারণ শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর ধারণা ছিল সাধারণ শিক্ষ্য়া বেশি মনযোগী হলে ধর্ম্য়ী শিক্ষা ও র্ধম অনুশীলনে অন্তরায় হবে। কিন্তু তাঁর সেই ধারণার অবসান হলো ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরর একান্ত সানিধ্যে এসে এ সময় তিনি উপলব্ধি করলেন সমাজের বৃহত্তর পরিসরে অবসান রাখতে হলে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার গুরু অত্যাধিক। পরবর্তীতে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পুনরায় তাঁর শিক্ষা জীবনস শুরু করেন। ২০০৮সালে এসএসসি ও ২০১১ সালে এইচএসসিতে উত্তীর্ণ হন। ধর্মীয় শিক্ষায় তিনি পালিও সংস্কৃত শিক্ষা বোর্ডের অধীনে বিনয় ও সূত্র পিটক এ অধ্যায়ণরত আছেন। শ্রমণ অবস্থায় ধর্মের প্রতি আগ্রহ এবং শীল পালনে কঠোর ব্রত এবং ভাবনা অনুশীলনে আগ্রহ লক্ষ্য করে বিদর্শন সাধক ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথের ভিক্ষু হওয়ার আহব্বান জানালে সানন্দে ভিক্ষু গ্রহণে সম্মত হন। এরপর পটিয়া উপজেলাধীন কর্ত্তালা বেলখাইন সদ্ধর্মলংকারী বিহারের বন্ধসীমায় ২০০৫ সালে দানোত্তম শুভ কঠিন চীবর দানোৎসবে প্রজ্ঞানন্দ মহাথের তাঁকে উপসম্পদা প্রদান করে নাম রাখা হয় দীপানন্দ ভিক্ষু। সে সময় থেকে ঐ বিহারে আবাসিক ভিক্ষু হিসাবে ২০১০ সাল পর্যন্ত বর্ষাবাস যাপন করেন। তখন পিন্ডচারণের মাধ্যমে ভিক্ষান্ন গ্রহণ করতেন। তারই গুরু নির্দেশে কোলাগাঁও রতœাংকুর বিহারে ২০১০ সাল হতে ২০১২ সাল পর্যন্ত বর্ষাবাস যাপন করেন। ঐ সময় কক্সবাজার জেলার ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ অধ্যসিত জনপদ রামুর বৌদ্ধ বিহার বৌদ্ধ পল্লী ও বৌদ্ধ ঐতিহাসিক স্থাপনায় কতিপয় দুর্বৃত্ত কর্তৃক স্মরণকালের জঘন্যতম ন্যাক্কারজনক ভাবে অগ্নিসংযোগ,ভাংচুর, হামলা ও লুটপাটে ইতিহাসের এক কলংকজনক ইতিহাস সুচিত হয়। এর পরদিন উখিয়া, টেকনাফ, পটিয়ায় লাখেরা ও কোলাগাঁওয়ের বৌদ্ধ বিহার ও পল্লীতে বুদ্ধ মূর্তি ভাংচুর অগ্নিসংযোগ ঘটনা সংগঠিত হলে তখন আজকের আলোচিত প্রাসঙ্গিক বৌদ্ধ ভিক্ষু ব্যক্তিত্ব দীপানন্দ ভিক্ষু পটিয়াস্থ কোলাগাঁও রতœাংকুর বিহারে অবস্থান করেছিলেন। তখন উনার সাহসিকতারপূর্ণ ভূমিকার কারণে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও স্থানীয় ইউপি এর তড়িৎ হস্তক্ষেপে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এগিয়ে এসে ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এছাড়াও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি ও বৌদ্ধদের নিরাপত্তা ও মানবধিকার রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জ্ঞাপন করেন। সে সময় বৌদ্ধদের মানবধিকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষায় বিশ্ববাসী ও সরকারের সুদৃষ্টি আকর্ষশন এবং দেশের প্রগতিশীল মুক্তচিন্তার সকল দেশবাসীর জনমত গঠনে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশী বৌদ্ধদের প্রতিনিধিত্ব মূলক একমাত্র মানবধিকার সংগঠন “বাংলাদেশ মাইনোরিটি বুড্ডিষ্ট এসোসিয়েশন’’। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অদ্যবধি উক্ত প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকে সমাজেও সদ্ধর্মের উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছেন। বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো- “বাংলাদেশ মাইনোরিটি বুড্ডিষ্ট এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান” “প্রজ্ঞানন্দ ওয়েল ফেয়ার ট্রাষ্টের’’ সভাপতি, বাংলাদেশ বুড্ডিষ্ট প্রেস কাউন্সিল এর ধর্মীয় সম্পাদক, সর্বধর্মীয় সম্প্রতি পরিষদ চট্টগ্রামের আহবায়ক, কধুরখীল মারজিন বিহারের সভাপতি ও অধ্যক্ষ এবং সংঘরাজ পূর্ণাচার ভিক্ষু সংসদের প্রভাতি ধর্মীয় বৃত্তি পরীক্ষা-২০১৫ উদ্যাপন পরিষদের সহসভাপতি ও বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন। উল্লেখ্য যে, রামু, উখিয়া, লাখেরা ও কোলাগাঁও এর বৌদ্ধ বিহার ও পল্লীতে হামলা অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, লুটপাটের মামলায় বাদী ছিলেন বিধায় উনাকে বিভিন্ন সময়ে মামলা তুলে নিতে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারীরা তাঁর প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করা হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও উনার দৃঢ় অবস্থান থেকে এক চুল পরিমাণও কেউ নড়াতে পারিনি। তারপরও কতিপয় দুষ্কৃতিকারী পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন নামে বেনামে মামলা তুলে নেবার হুমকি ও চাপ দিতে থাকলে ২০১৩ সালে শাকপুরা বিদর্শন ভাবনাকেন্দ্রের আবাসিক ভিক্ষু হিসাবে অবস্থান করে বর্ষাবাস যাপন করেন। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ মাইনোরিটি বুড্ডিষ্ট এসোসিয়েশনের প্রতিনিধি হিসাবে দিল্লি ভারতের মানবধিকার সংস্থার প্রতিনিধি ও ভারতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সাথে বাংলাদেশী বৌদ্ধদের মানবধিকার ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষায় মত বিনিময় করেন। ২০১৪ সালে ঢাকায় প্রথম সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সম্মেলনে যোগদান করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। তৎমধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল ২০১৬ ইংরেজী সালের ১ম সংঘরাজ সারমেধ আন্তর্জাতিক গবেষণা ও সম্মানা ফাউন্ডেশন কর্তৃক শান্তি সম্মানা, সার্ক কালচারাল ফোরাম (ভারত) কর্তৃক লাইফ টাইম এচিভমেন্ট এ্যাওয়ার্ড’২০১৭ লাভ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি কর্তৃক মানবতাবাদী, সমাজ ও পরিবেশ উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় সম্মাননা স্মারক’২০১৭ লাভ করেন। তিনি ভারত থেকে এসে পুনরায় শাকপুরা বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রে অবস্থান করেন। এ সময় ২০১৪ সাল হইতে বোয়ালখালী পৌরসভাধীন কধুরখীল মারজিন বিহারের বিহারাধ্যক্ষের পদ শূন্য হলে সেই হতে অত্র বিহারের বিহারধ্যক্ষ হিসাবে বর্ষাবাস যাপন শুরু করেন। ২০১৫ সালে বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সংঘ যুব এর সভাপতি ড.মি: পিন এপং (থাইল্যান্ড) বাংলাদেশে আগমন করলে কধুরখীল মারজিন বিহার পরিদর্শনে আসেন এবং দীপানন্দ স্থবির এর সাথে বৌদ্ধদের সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা ও তার উত্তরনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মত বিনিময় করেন। তিনি এ পর্যন্ত যে সকল বিহারে অবস্থান করেছেন প্রত্যেকটি বিহারে উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা অন্যতম। বিশেষ করে কোলাগাঁও রতœাংকুর বিহারের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত তারই নেতৃত্বে কধুরখীল মারজিন বিহারে এসে উদ্যোগে মহাবোধি চত্ত্বর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অসমাপ্ত নবনির্মিত বিহারের উন্নয়ন কাজ ত্বরান্বিত করতে বিভিন্ন দানশীল ব্যাক্তিত্ব ও সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান সংগ্রহ করতে তাঁর বলিষ্ঠ অবদান দায়ক-দায়িকা সকলের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। তাঁর এ সকল কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ যে সকল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সন্মাননা স্মারক প্রদান করা হয় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- “বাংলাদেশী বৌদ্ধ কল্যান সমিতি কুয়েত”। অখিল ভারতীয় সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা, প্রজ্ঞাজ্যোতি বিদর্শন উন্নয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল ইতিহাস মঞ্চ ২০১৮ সম্মানা স্মারক লাভ করেন। পরিবেশ উন্নয়ন সোসাইটি হতে সমাজ সেবায় ২০১৮ সম্মানা স্মারক প্রদান করেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থা (রিভিউ) কেন্দ্রীয় ২০১৮ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যপদ লাভ করেন। কধুরখীল মারজিন বিহার প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানসহ তাঁর সামাজিক ও ধর্মীয় কৃতিত্বের ফলস্বরূপ তাকে সম্মাননা প্রদান করেছেন। পরিশেষে আমরা এ কর্মবীর বৌদ্ধ ভিক্ষু ব্যক্তিত্বের আগামী দিনগুলি মানব সমাজের তথা সর্বজীবের কল্যাণে নিবেদিত থেকে বুদ্ধের অমৃত বাণী প্রচার ও প্রসারে অনন্য অবদান রাখতে পারে তাঁর জন্য তথাগত সমীপে তাঁর নিরোগ ও দীর্ঘায়ু জীবন কামনা করি।
লেখক- উত্তম কুমার বড়ুয়া
কধুরখীল ,বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।