দেবতাখুমে নিবিড় প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে

0
254

মনের দুঃখে নাকি বনে যেতে হয়। সে যাই হোক, অনেক দিন ধরে মনটা বিশেষ ভালো ছিল না। কোথাও গিয়ে সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মনটা হালকা করতে ইচ্ছে করছিল। এমন একটা জায়গায় যেতে ইচ্ছে করছিল যেখানে থাকবে নিবিড় প্রকৃতির ছোঁয়া, থাকবে না কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং সেটা অবশ্যই হতে হবে একদিনের ভ্রমণ।

হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে কোথাও ঘুরতে গেলে নাকি অনেক ভালো ফল পাওয়া যায়। সেই থিওরিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে অবশেষে কেটেই ফেলি বান্দরবানের বাসের টিকিট। গন্তব্য বান্দরবনের রোয়াংছড়ি উপজেলার গহীনে দেবতাখুম।

২৮ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৩০ মিনিট। মতিঝিল এলাকার আরামবাগ থেকে বাসে উঠি এবং সকাল ৭টায় বান্দরবান পৌঁছাই। নেমে দেখি আমাদের জন্য সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে আগেই গাইড ও সিএনজি ঠিক করে রাখি। সারা দিনের জন্য যাওয়া-আসাসহ সিএনজি রিজার্ভ ২০০০ টাকা ও গাইড ১০০০ টাকা। বান্দরবান থেকে দেবতাখুম যেতে হলে প্রথমে যেতে হবে রোয়াংছড়ি থানায়। সেখানে পুলিশের অনুমতি নিতে হবে। এরপর রোয়াংছড়ি থেকে যেতে হবে কচ্ছপতলী আর্মি ক্যাম্পে। সেখান থেকে আবার আর্মির অনুমতি নিতে হবে। তবে গাইড এসব কাজকর্ম ঝটপট করে ফেলে। শুধু ট্রাভেলারদের তাদের সাথে সাথে থাকতে হবে এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের দুইটি ফটোকপি জমা দিতে হয়। বান্দরবান শহর থেকে রোয়াংছড়ির দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। রোয়াংছড়ি থেকে কচ্ছপতলী ৫-৬ কিলোমিটার।

স্কুলের ক্লাসের ভালো ছাত্রের মতো আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করার পর শুরু হয় দেবতাখুমের উদ্দেশে ট্রেকিং। এটি মোটামুটি মধ্যম মানের একটি ট্রেকিং রুট। কচ্ছপতলী থেকে দেবতাখুম পৌঁছতে আমাদের সময় লাগে দেড় ঘণ্টার মতো। পাহাড়, বন ও ঝিরির পাশ দিয়ে ট্রেকিং করার মুহূর্তগুলো মনে একেবারে দাগ কেটে গেছে। ঝিরি পার হতে হয়েছে কয়েকবার। কখনো চড়াই বেয়ে উঠছি তো কখনও উতরাই বেয়ে নামছি। এক সময় পৌঁছে যাই শীলবান্ধা পাড়ায়। এখান থেকে তাকালে নৌকা ঘাটের টিকিট কাউন্টার চোখে পড়ে। পাড়া থেকে হেঁটে নৌকা ঘাট পর্যন্ত যেতে লাগে সাত থেকে আট মিনিট। হেঁটে যাওয়ার সময় পাশে পড়ে এক সুন্দর মনমাতানো ভ্যালি। শীলবান্ধা পাড়ার পাশে শীলবান্ধা ঝর্ণা নামে একটি ঝর্ণা আছে; যদিও আকারে খুব ছোট এবং শীতকালে পানি খুবই কম থাকে।

দেবতাখুমের ভিতরে ঘুরে দেখার জন্য নৌকা ও ভেলার ব্যবস্থা রয়েছে। জনপ্রতি ১৫০ টাকায় লাইফ জ্যাকেটসহ এ সুবিধা পাওয়া যায়। প্রতিটি ভেলায় একজন এবং নৌকায় সর্বোচ্চ দশজন উঠা যায়। খুমের ভিতরে গভীরতা ৫০ থেকে ৭০ ফিট ও দৈর্ঘ্যে ৬০০ ফিট। এটি বান্দরবানের আরেক জনপ্রিয় ভ্রমণ স্থান ভেলাখুম থেকে অনেক বড় এবং অনেক বেশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। পাহাড়ে ট্রেকিং সব সময়ই রোমাঞ্চকর। আর সেটা যদি হয় পাহাড়ি ঝিরিপথে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে; তবে সেটা নিঃসন্দেহে দেবে এক স্বর্গীয় অনাবিল সুখ। মনে হবে দুঃখ-কষ্ট, বেদনা কিংবা ক্লান্তি বলতে কিছুই নেই।

উল্লেখ্য, সারা বছর দেবতাখুম যাওয়া গেলেও ভরা বর্ষায় অনেক সময় ঝিরি ও খুমে পানি অতিরিক্ত বেড়ে যায় এবং সেক্ষেত্রে আর্মি যাওয়ার অনুমতি দেয় না। অন্যদিকে শীতের শেষ থেকে গ্রীষ্মের শুরু পর্যন্ত পানি অনেক কমে যায়। তখন দেবতাখুম ভালো নাও লাগতে পারে। এসব হিসাব বিচার-বিবেচনায় দেবতাখুম ঘুরার আদর্শ সময় হলো সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। দেবতাখুম যেতে চাইলে এ সময়ের মধ্যেই ভ্রমণ পরিকল্পনা করা ভালো।

লেখক: আশরাফুল আলম : পরিবেশকর্মী ও প্রতিষ্ঠাতা, ভ্রমণীয়