পদ্মা রেললিংকসহ সব রুটে ইলেকট্রিক ট্রেনের পরিকল্পনা

0
51

রেলপথে গতি আনতে ও যাত্রী সুবিধার কথা চিন্তা করে পদ্মাসেতু রেল লিংকসহ সারাদেশের রেলপথে ইলেকট্রিক ট্রেন চালুর পরিকল্পনা হাতে নিতে যাচ্ছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। যদিও মেট্রোরেল ছাড়া বাংলাদেশে কোনো রেলপথেই বৈদ্যুতিক সংযোগ নেই।

তবে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু রেল সংযোগে এই ব্যবস্থা চালু করা হবে।

ঢাকাসহ দেশের মধ্য-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়কপথে যোগাযোগ স্থাপনে স্বপ্নের পদ্মাসেতু গড়তে কাজ করছে সরকার। এই সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমে রেলওয়ে যোগাযোগও চালু করার কাজ চলছে। এজন্য ‘পদ্মাসেতু রেল সংযোগ প্রকল্প’ অনুমোদন দেওয়া হয়। ঢাকা থেকে পদ্মা বহুমুখী সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত নতুন ব্রডগেজ রেলওয়ে ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে, যার দৈর্ঘ্য হবে ১৬৯ কিলোমিটার। লুপ সাইডিং (লাইন বদলের জন্য) এবং ডাবল লাইনসহ মোট ট্র্যাক হবে ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার। নির্মাণাধীন প্রকল্পে নতুনভাবে ইলেকট্রিক ট্রেনের প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হবে।

ইলেকট্রিক ট্রেন সর্বোচ্চ ওজন বহনে সক্ষম এবং পরিবেশবান্ধব। পাশাপাশি এই ট্রেনগুলোর পরিবহন ব্যয়ও কম। মাত্র চার ইউনিট বিদ্যুতে এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারবে। প্রতি ইউনিট খরচ ১০ টাকা হলে এক কিলোমিটারে খরচ হবে মাত্র ৪০ টাকা। যেখানে ডিজেল চালিত ট্রেনে প্রতি কিলোমিটার জ্বালানি খরচ হাজার টাকারও বেশি।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রেলওয়ে ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন প্রবর্তন করা বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য একটি মাইলফলক হবে। এর ফলে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু হলে ভ্রমণ সময় ও অপারেশনাল ব্যয় হ্রসের পাশাপাশি যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া শহরগুলোতে ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। ফলে তা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

মন্ত্রণালয়ের দাবি, মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুটি ইউনিটে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে। অন্যদিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল পর্যায়ের কাজ। দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদন হবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এসব বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হলে দেশের বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা হবে ২৪ হাজার মেগাওয়াট। ২০৩০ সাল নাগাদ ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে একটি মাস্টার পরিকল্পনা তৈরি করেছে সরকার।

এক সময় দেশে চাহিদার থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন বেশি হবে। বাড়তি বিদ্যুৎ ব্যবহারের মহাপরিকল্পনা হিসেবে সকল রুটে ইলেকট্রিক ট্রেন চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। চলমান খুলনা-মোংলা ৬৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করা হবে। দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ প্রকল্পের অধিগ্রহণ প্রায় ৬৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। আর বাকি আছে ৩৫ শতাংশ। এই পথেও নতুন করে সংযোজন করা হবে ইলেকট্রিক সিস্টেম।

এই প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বাংলানিউজকে বলেন, পদ্মাসেতু রেলসংযোগে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এছাড়া ঢাকা চট্টগ্রাম রুটেও ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করবো। তাছাড়া ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করতে পারলে রেলপথ লাভজনক হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও পদ্মাসেতু রেলসংযোগে ইলেকট্রিক ট্রেন চলবে। নতুন রেলপথ নির্মাণ করলেই ইলেকট্রিক ট্রেনের প্রভিশন রাখবো। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করার মহাপরিকল্পনা নিতে যাচ্ছি।

তিনি আরো বলেন, এক সময় দেশে বিদ্যুতের অভাব ছিল, বার বার লোডশেডিং হতো। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমরা বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। শুধু তাই নয়, দেশে চাহিদার থেকে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। সামনে বিদ্যুতের উৎপাদন আরো বাড়বে। ফলে বাড়তি বিদ্যুৎ আমরা রেলপথে ব্যবহার করতে পারবো। নতুন রেলপথ যেগুলো নির্মিত হচ্ছে সেখানে ইলেকট্রিক সিস্টেম চালু থাকবে। পুরনো রেলপথের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ইলেকট্রিক ট্রেন চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন চলমান রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ইলেকট্রিক সিস্টেম চালু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পুরনো রেলপথ ঢাকা-চট্টগ্রামে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করার জন্য সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রথমে বিশাল উদ্যোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের নারায়ণগঞ্জ হতে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন (ওভারহেড ক্যাটেনারি ও সাব স্টেশন) নির্মাণসহ প্রবর্তননের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। চলতি সময় থেকে ২০২২ সালের আগস্ট মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের দফতরে পাঠিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নানা কারণে এই পুরনো রেলপথটিকে ইলেকট্রিক রুটে রুপ দেওয়া হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং টঙ্গী-জয়দেবপুরের মধ্যে চলমান ডাবল লাইন প্রকল্পটি ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন ব্যবহারে আরও কার্যকরী হবে। নারায়ণগঞ্জ দেশের অন্যতম প্রধান এবং কেন্দ্রীয় শিল্প-ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র। চট্টগ্রামের প্রধান সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ আমদানি-রফতানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ৩০ শতাংশ জনসংখ্যা নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে। এছাড়া এই অঞ্চলে সহজেই বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, যে কারণে এই অঞ্চল দিয়ে চালু হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম ইলেকট্রিক ট্রেন।

প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যমান নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন নির্মাণের প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক আর্থিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত উপযোগিতা যাচাই, ওভারহেড ক্যাটেনারি, সাব-স্টেশন এবং উপযুক্ত প্রযুক্তির চাহিদা নির্ধারণ এবং ভবিষ্যত কৌশল সম্পর্কে সুপারিশ দেওয়া হবে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে প্রকল্পের জন্য বিদ্যুতের বর্তমান চাহিদা ও প্রাপ্যতা নির্ধারণ করা এবং ভবিষ্যত কৌশল নির্ধারণ করা হবে। বাংলাদেশের মতো একই প্রাকৃতিক এবং অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অন্য দেশে গৃহীত ইলেকট্রিক ট্রাকশন সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যত কৌশল সম্পর্কে সুপারিশ করা হবে।

বিদ্যমান নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ট্র্যাফিক পূর্বাভাস, লেভেল ক্রসিং গেট এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের ওপর ইলেকট্রিক ট্রাকশন গ্রহণ সম্পর্কিত স্পর্শকাতরতা বিশ্লেষণসহ বিস্তারিত প্রকৌশল নকশা প্রণয়ন; বিস্তারিত নকশার ওপর ভিত্তি করে বিস্তারিত ব্যয় প্রাক্কলন তৈরি হবে।

সমীক্ষা প্রকল্পের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ৪ জন এবং স্থানীয় ১৩ জন পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হবে।

এছাড়া প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কার্যক্রম লক্ষ্য করা গেছে। প্রথমে ন্যাশনাল পাওয়ার গার্ড লাইন, গার্ড স্টেশনের নিকটবর্তী স্থানে ইলেকট্রিক্যাল সাব-স্টেশনগুলো স্থাপনের উপযুক্ত এলাকা নির্বাচন করা হবে। তবে ট্র্যাকশন রিকোয়্যারমেন্টের জন্য ইলেকট্রিক পাওয়ার সাপ্লাইয়ের বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ইতিবাচক মতামত পাওয়া গেছে।