ইসলামে দান-সদকার গুরুত্ব ও ফজিলত

0
206

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মানবতার মুক্তির দূত, সাইয়্যেদুল মুরসালিন খাতামুননাবিয়ীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আল্লাহ ছোবাহানাহু তায়ালা বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনীর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ । তাঁর প্রতিটি কথা, কাজ, অনুমোদন, নির্দেশনা, আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণের বার্তাবাহী। তিনি গোটা মানব জাতির শিক্ষক। তাঁর সে কালজয়ী আদর্শ ও অমিয়বাণী দ্যুাতি ছড়িয়ে পথপদর্শন করেছে যুগ যুগান্তরে,আলোকিত হয়েছে মানবমন্ডলী ।
গোপন-প্রকাশ্যে যে কোনোভাবে দান করা যায়। সব দানেই সওয়াব রয়েছে। দানের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে রিজিকের ভারসাম্য রক্ষা করেন। বিনিময়ে প্রতিদানও দিয়ে থাকেন । মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-সদকা কর, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি গোপনে ফকির-মিসকিনকে দান করে দাও, তবে আরও বেশি উত্তম। আর তিনি তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন।’ (সুরা : বাকারা-২৭১) সদকা কাকে বলে ? ইসলামি পরিভাষায় দান করাকেই সদকা বলা হয়। সদকা শব্দটি এসেছে আরবি ‘সিদকুন’ থেকে। অর্থ : সত্যতা, যথার্থতা। পরিভাষায় সদকা বলা হয়, একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার লক্ষ্যে স্বীয় সম্পদ ব্যয় করা। কারণ, মানুষের সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু এবং জীবনযাপনের প্রধান উপকরণ কষ্টার্জিত মাল ব্যয় করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার প্রতি ভালোবাসা এবং তার নির্দেশাবলীর প্রতি আনুগত্যের বাস্তব প্রমাণ দিয়ে থাকেন বলে এ ব্যয়কে সদকা নামে অভিহিত করা হয়েছে।পবিত্র কোরআন-হাদিসে অত্যাবশ্যক এবং ঐচ্ছিক এ উভয় প্রকার দানকেই সদকা বলা হয়েছে। তবে প্রচলিত অর্থে শুধু ঐচ্ছিক নফল দানকেই সদকা বলা হয়ে থাকে।
সদকার প্রকার:
সদকা দুই প্রকার । (১) সাধারণ সদকা ও (২) সদকায়ে জারিয়া। গরিব-দুখীকে টাকা-পয়সা দান করা, ভালো ব্যবহার করা সাধারণ সদকার অন্তর্ভুক্ত। আর সাদকায়ে জারিয়া বলা হয় ওই সব সৎকর্ম যেগুলোর কল্যাণকারিতা স্থায়ী হয়। এর মধ্যে সর্বাগ্রে হচ্ছে দ্বীনি এলেম শিক্ষা দান, দ্বীনি বই-পুস্তক রচনা ও প্রকাশ করে সর্বসাধারণের মধ্যে এলেম পৌঁছানো। কারণ, দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে মানব সন্তানের জন্য সর্বাধিক কল্যাণকর বিষয় হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে, তাঁর বিধিবিধানের সঙ্গে এবং রাসুলের সঙ্গে পরিচিতি লাভ। এক ব্যক্তি অন্যকে যদি দ্বীনি এলেম শিক্ষা দেন তবে সে ব্যক্তি নিজে আমল করবে এবং প্রত্যক্ষভাবেই হোক বা পরোক্ষভাবেই হোক,পরবর্তী সময়ে কাউকে না কাউকে শিক্ষা দেবে। এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত এ সৎকাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। হজরত মুহম্মদ (সা.) ওই ব্যক্তিকে সর্বাপেক্ষা বড় দাতারূপে আখ্যায়িত করেছেন, যিনি পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর এলেম অন্যদের শিক্ষা দেন। তার পরের স্থান মসজিদ, এতিমখানা, মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট, সেতু পুকুর প্রভৃতি গণকল্যাণমূলক খাতে দান করা। এসবের দ্বারা অনেক বেশি লোক উপকৃত হন এবং উপকারটুকু দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। হজরত আবু হুরায়াহ (রা.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুলপাক (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে, তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি ব্যতীত সদকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান অথবা সৎকর্মশীল সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম শরিফ-১৬৩১) ইমাম আন-নববী (রহ.) এ হাদিস খানার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সদকায়ে জারিয়া হলো ওয়াকফ।’ (শরহে মুসলিম -১১/৮৫) ।
কোরআনে দান-সদকার নির্দেশ:
অসংখ্য আয়াতে দান-সদকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, তারা আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে? (আল্লাহ বলেন,) জানিয়ে দিন, যা তোমাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত।’ (সুরা বাকারা-২১৯) মহান আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেছেন, হে ঈমানদাররা! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-খয়রাত বরবাদ করো না, সে ব্যক্তির মতো যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। অতএব, এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মতো যার ওপর কিছু মাটি পড়েছিল। অতঃপর এর ওপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অনন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিল। তারা ওই বস্তুর কোনো সওয়াব পায় না, যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না।’ (সুরা : বাকারা-২৬৪) অপর আয়াতে বলেন, যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এবং নিজের মনকে সুদৃঢ় করার জন্য তাদের উদাহরণ টিলায় অবস্থিত বাগানের মতো, যেন প্রবল বৃষ্টিপাত হয়; অতঃপর দ্বিগুণ ফসল দান করে। যদি এমন প্রবল বৃষ্টিপাত না-ও হয়, তবে হাল্কা বর্ষণই যথেষ্ট। আল্লাহ তোমাদের কাজকর্ম যথার্থই প্রত্যক্ষ করেন।’ (সুরা : বাকারা-২৬৫) এছাড়াও সুরা আয্যারিয়াতের ১৯ নাম্বার আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই তোমাদের সম্পদে নিঃস্ব ও অসহায়দের অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ আমরা যা দান করি, কোরআনের দৃষ্টিতে তা দয়া নয়; তা অসহায়দের অধিকার বা হক্কুল ইবাদ। আপনি যখন দান করেন, তখন আপনি সৃষ্টির অধিকারকেই সম্মান করেন। তখন স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ আপনাকে সম্মানিত করবেন। অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন, এবং তাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক রয়েছে। ভিক্ষুক এবং বঞ্চিত (অভাবী অথচ লজ্জায় কারও কাছে হাত পাতে না) সবার হক রয়েছে।’ (সুরা: মাআরেজ : ২৪-২৫) পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহপাক আরও এরশাদ করেন, যারা আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করে তার উদাহরণ হচ্ছেÑ সেই বীজের মতো যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। আর প্রতিটি শীষে একশতটি করে দানা থাকে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অতিরিক্ত দান করেন। আল্লাহ সুপ্রশস্ত সুবিজ্ঞ।’ (সুরা: বাকারা : ২৬১) ।
হাদিসে দান-সদকার নির্দেশ:
অসংখ্য হাদিসেও দান-সদকার ফজিলত তুলে ধরা হয়েছে। গোপনে দান করার ব্যাপারে হাদিসে অধিক ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। গোপনে দানকারী কেয়ামতের দিন মহান আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে, নবী (সা.) বলেন, ‘কেয়ামত দিবসে সাত শ্রেণির মানুষ আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে। তাদের মধ্যে একশ্রেণি হচ্ছে, ‘এক ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কি দান করে বাম হাত জানতেই পারে না।’ (বোখারি ও মুসলিম) দান-ছাদকা গোনাহ মাফ করে ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায়। নবী (সা.) বলেন, ‘হে কাব বিন উজরা! নামাজ (আল্লাহর) নৈকট্য দানকারী, রোজা ঢাল স্বরূপ এবং দান-ছাদকা গোনাহ মিটিয়ে ফেলে যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে।’ (আবু ইয়ালা, সনদ সহীহ)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘খেজুরের একটি অংশ দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা কর।’ (বোখারি ও মুসলিম) বর্তমান যুগে অনেক মানুষ এমন আছে, যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে দান করে এবং তা মানুষকে দেখানোর জন্য। মানুষের ভালোবাসা নেওয়ার জন্য। মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য। মানুষের মধ্যে গর্ব অহংকার প্রকাশ করার জন্য। অনেকে দুনিয়াবি স্বার্থ সিদ্ধির জন্যও দান করে থাকে। যেমন, চেয়ারম্যান বা এমপি নির্বাচনে জেতার উদ্দেশ্য দান করে। কিন্তু দান যদি একনিষ্ঠভাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য না হয় তা দ্বারা হয়তো দুনিয়াবি কিছু স্বার্থ হাসিল হতে পারে ; কিন্তু আখেরাতে এর কোনো প্রতিদান পাওয়া যাবে না। হাদিসে কুদসিতে নবী (সা.) বলেন,‘আমি শিরককারীদের শিরক থেকে মুক্ত। যে ব্যক্তি কোনো আমল করে তাতে আমার সঙ্গে অন্যকে শিরিক করবে, তাকে এবং তার শিরকির আমলকে আমি পরিত্যাগ করব ।’ (মুসলিম)।
সদকা শুধু সম্পদ বিসর্জন বা অন্যকে খাদ্য খাওয়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মাধ্যমেও সদকা করা যায়। এর মাধ্যমে অন্যের হৃদয়ে ভালোবাসা ও সম্প্রীতি তৈরি হয়। অনুভূতির সদকার মূলমন্ত্র হলো পরোপকার, কোমল ব্যবহার ও বিনম্র ভাষায় কথা বলা। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ দয়াশীল বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। সুতরাং তোমরা জমিনবাসীর প্রতি দয়া-প্রদর্শন করো, যিনি আকাশে আছেন (আল্লাহ), তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৪১)
লোক দেখানো দান-সদকার শাস্তি:
যারা মানুষের প্রশংসা নেয়ার উদ্দেশ্যে দান করবে, তাদের দ্বারাই জাহান্নামের আগুনকে সর্বপ্রথম প্রজ্বলিত করা হবে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তিকে দিয়ে জাহান্নামের আগুনকে প্রজ্বলিত করা হবে।… তাদের মধ্যে (সর্ব প্রথম বিচার করা হবে) সেই ব্যক্তির, আল্লাহ যাকে প্রশস্ততা দান করেছিলেন, দান করেছিলেন বিভিন্ন ধরনের অর্থ-সম্পদ। তাকে সম্মুখে নিয়ে আসা হবে। অতঃপর (আল্লাহ) তাকে প্রদত্ত নেয়ামত পরিচয় করাবেন। সে তা চিনতে পারবে। তখন তিনি প্রশ্ন করবেন, কি কাজ করেছ এই নেয়ামতসমূহ দ্বারা? সে জবাব দিবে, যে পথে অর্থ ব্যয় করলে আপনি খুশি হবেন এ ধরনের সকল পথে আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেছি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এরূপ করেছ এই উদ্দেশ্যে যে, তোমাকে বলা হবে, সে দানবীর। আর তা তো বলাই হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হবে। তখন তাকে মুখের ওপর উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম)
কাদের দান করা যাবে?
কাদের দান করা যাবে এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে তাদের তালিকা দেয়া হয়েছে। যথা :
‘যাকাত হলো কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায় কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদে হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে-ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা: তাওবা, আয়াত : ৬০)
এ আয়াত দ্বারা ফকিহগণ মোট আট শ্রেণির লোকদের দান করার কথা বলেছেন ।
(১) গরীব। যার সম্পদ আছে কিন্তু নেসাব পরিমাণ মালের মালিক নয় ।
(২) মিসকিন। যার একদমই কোন সম্পদ নেই ।
(৩) ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য শরীয়ত নির্দিষ্ট যাকাত আদায়কারী আমেল। এটা ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান দ্বারা নিযুক্ত হতে হবে। নিজে নিজে মনে করে নিলে হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিক্বহ-৬/৬৯)
(৪) নব মুসলিমদের ইসলামের প্রতি মোহাব্বত বাড়ানোর জন্য উৎসাহমূলক যাকাত প্রদান। এ বিধানটি রহিত হয়ে গেছে। তাই বর্তমানে কোনো ধনী নওমুসলিমকে জাকাত প্রদান জায়েজ নয়। (হিদায়া-১/১৮৪, মাআরিফুল কুরআন-৪/১৭১, তাফসীরে মাযহারী-৪/২৩৫)
(৫) দাসমুক্তির জন্য। যেহেতু বর্তমানে দাসপ্রথা নেই। তাই এ খাতটি বাকি নেই।
(৬) ঋণগ্রস্তের জন্য ।
(৭) ফীসাবিলিল্লাহ। তথা আল্লাহর রাস্তায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য। এখন প্রশ্ন হলো আল্লাহর রাস্তায় কারা আছে? ফুক্বাহায়ে কেরাম বলেন এতে রয়েছেন, জিহাদরত মুজাহিদরা। তাদের জিহাদের অস্ত্র ও পাথেয় ক্রয় করার জন্য জাকাতের টাকা গ্রহণ করবে। হজের সফরে থাকা দরিদ্র ব্যক্তির জন্য। ইলমে দ্বীন অর্জনকারী দরিদ্র ব্যক্তির জন্য। (আদ দুররুল মুখতার-৩৪৩, হিদায়া-১/১৮৫, রূহুল মাআনী-৬/৩১৩)
(৮) সফররত ব্যক্তিকে। যার টাকা পয়সা আছে বাড়িতে। কোনো সফর অবস্থায় অসহায়। তাকে যাকাতের টাকা দেয়া জায়েজ ।
সংক্ষেপে অনুভূতির সদকা করার কিছু উপায় তুলে ধরা হলো:
হাসিমুখে কথা বলা : মানুষকে আনন্দিত করার একটি বিশেষ উপায় হলো ছোট-বড়-নির্বিশেষে সবার সঙ্গে সর্বদা হাসিমুখে কথা বলা। রাসুল (সা.) বলেছেন,‘প্রতিটি ভালো কাজ সদকাস্বরূপ। তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা এবং তোমার বালতির পানি দিয়ে তোমার ভাইয়ের পাত্র ভর্তি করে দেওয়াও নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৭০)
অন্যত্র রাসুল (সা.) বলেন, ‘হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তোমার ভাইয়ের সামনে উপস্থিত হওয়া তোমার জন্য সদকাস্বরূপ।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৫৬)
সালাম দেওয়া : ছোট-বড়, পরিচিত-অপরিচিত-নির্বিশেষে সব মুসলিমকে সালাম দেওয়া ইসলামী শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা ঈমানদার হবে। আর ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদের এমন একটি কাজের কথা বলে দেব না, যা করলে তোমাদের মাঝে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তোমরা একে অপরের মাঝে সালামের প্রসার ঘটাও।’ (মুসলিম, হাদিস : ৫৪)
এতিমের মাথায় হাত বোলানো : এতিমদের মাথায় হাত বুলিয়ে, আদর ও সেবা দিয়ে তাদের হৃদয়ে সুখানুভূতি সঞ্চার করা যায়। যেসব মুমিন বান্দা এতিমদের আদর করে এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করে, তারা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে জান্নাতে বসবাস করার সৌভাগ্য হাসিল করতে পারবে। (বুখারি, হাদিস : ৫৩০৪)
বড়দের সম্মান করা এবং ছোটদের স্নেহ করা : বড়দের সম্মান করা ও ছোটদের স্নেহ করার মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ নির্মিত হয়। ইসলাম এ ব্যাপারে জোর তাগিদ দিয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ওই ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়, যে আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দের সম্মান করে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯১৯)
বিবাদ মীমাংসা করা : ইসলাম মানব জাতিকে সম্প্রীতি বজায় রেখে জীবন যাপনের নির্দেশ দেয়। একদিন রাসুল (সা.) সাহাবীদের বলেন, ‘আমি কি তোমাদের সালাত, সিয়াম ও সদকার চেয়েও উত্কৃষ্ট আমলের ব্যাপারে বলব না?’ সাহাবিরা বলেন, হ্যাঁ, বলুন। তখন তিনি বলেন, ‘পরস্পর সুসম্পর্ক স্থাপন করা। কারণ পরস্পর সুসম্পর্ক নষ্ট হওয়ার অর্থ হলো দ্বীন বিনষ্ট হওয়া।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯১৯)
মানুষকে সুসংবাদ দেওয়া : কাউকে কোনো বিষয়ে বা নেকির কাজের ব্যাপারে আশান্বিত করা এবং সুসংবাদ দেওয়া আমলে সালেহের অন্তর্ভুক্ত। রাসুল (সা.) যখন কোনো সাহাবিকে কোনো কাজে প্রেরণ করতেন, তখন তাকে নির্দেশ দিতেন, ‘তোমরা লোকদের সুসংবাদ দেবে, দূরে ঠেলে দেবে না। আর সহজ করবে, কঠিন করবে না।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৭৩২)
রোগীর সেবা করা : অনুভূতির সদকা প্রকাশ করার অন্যতম উপায় হলো রোগীর সেবা করা এবং তাকে দেখতে যাওয়া। এই কাজের মাধ্যমে রোগী এবং রোগীর পরিবারের সঙ্গে যেমন আত্মিক হৃদ্যতা তৈরি হয়, তেমনি ফেরেশতাদের দোয়া লাভ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ৯৭৬)
আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেওয়া : রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি হচ্ছে, যারা বেশি বেশি মানুষের উপকার করে। আর আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় কাজ হচ্ছে কোনো মুসলিমকে খুশি করা অথবা কোনো মুসলিম ভাইয়ের বিপদ দূর করা অথবা কোনো মুসলিম ভাইয়ের ঋণ পরিশোধ করা অথবা কোনো ভাইয়ের ক্ষুধা নিবারণ করা। কোনো মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন (অভাব) পূরণের জন্য তার সঙ্গে হাঁটা (সময় দেওয়া) আমার কাছে এক মাস মদিনার মসজিদে (মসজিদে নববী) ইতিকাফ করার চেয়েও অধিকতর প্রিয় কাজ।’ (তাবারানি, মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৬০২৬)
হাদিয়া দেওয়া : অন্যের সঙ্গে ভালোবাসা ও সুসম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম সেতুবন্ধ হলো পরস্পর হাদিয়া বা উপহার দেওয়া। রাসুল (সা.) অন্যের হাদিয়া গ্রহণ করতেন এবং নিজেও হাদিয়া দিতেন। তিনি সাহাবিদের এ ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলতেন, ‘তোমরা পরস্পর উপহার আদান-প্রদান করো, তাহলে তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে।’ (তাবারানি, আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৭২৪০)
মানুষ মাত্রই মরণশীল । প্রত্যেক মানুষকেই মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে । আর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে এমন কিছু আমল রয়েছে যেগুলোর প্রতিদান বা সওয়াব মৃত ব্যক্তির আমলনামায় লেখা হতে থাকবে। সে রকম কিছু আমল এখানে বর্ণনা করা হলো ।
মানুষকে জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া :
এমন জ্ঞান (ইলম) শিক্ষা দেওয়া যা মানুষের জন্য কল্যাণকর। যে জ্ঞান মানবজাতিকে হেদায়েতের পথে নিয়ে যায় ও মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়। পবিত্র কোরআন-হাদিস, নিত্যপ্রয়োজনীয় মাসয়ালা শিক্ষার পাশাপাশি দুনিয়ার কল্যাণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান শিক্ষা দেওয়াও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ।
সুসন্তান রেখে যাওয়া :
সুসন্তান বলতে লেখাপড়ায় শুধু ভালো তা নয়, যার ঈমান-আমল ঠিক আছে, যে শরিয়তের বিধান মেনে চলার চেষ্টা করে। যারা পিতা-মাতা বেঁচে থাকতেও অনুগত ছিল, তাদের মৃত্যুর পরেও আল্লাহর কাছে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে ।
মসজিদ নির্মাণ ও কোরআনে কারিম বিতরণ:
পবিত্র কোরআনে কারিমে মসজিদকে বলা হয়েছে হেদায়েতের কেন্দ্র। হজরত ওসমান (রা.) থেকে বর্ণিত,হজরত রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য মসজিদ তৈরি করল, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর তৈরি করবেন ।’ (সহিহ মুসলিম)
বৃক্ষরোপণ করা:
হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি বৃক্ষরোপণ করে আর তা থেকে কোনো ফল ব্যক্তি বা হিংস্র প্রাণী খেলে তার জন্য সদকা, যদি কেউ চুরি করে খায় বা কোনো পাখিও খায় সেটিও তার জন্য সদকা। এমনকি যদি কেউ তা কেটে ফেলে সেটিও তার জন্য সদকা।’ (সহিহ মুসলিম)।
মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা:
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে,‘যে মানুষকে হেদায়েতের দিকে আহ্বান করবে, তার আমলনামায় সম্পাদনকারীর অনুরূপ সওয়াব যুক্ত হতে থাকবে। অথচ তাদের সওয়াব থেকে কোনো কমতি হবে না।’ (সহিহ মুসলিম)
হজরত আবু উমামাতা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘মৃত্যুর পরও অনেক আমলের সওয়াব অব্যাহত থাকে। যেমন ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা দেওয়া ও পানির কূপ খনন করা।’ (মুসনাদ আহমাদ)।
‘সদকা’ বলতে আমরা বুঝি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াবের আশায় কাউকে অর্থ-সম্পদ, খাবার, পোশাক ইত্যাদি প্রদান করা। ‘সদকা’-কে এই সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা হলে মনে হবে সদকার সম্পর্ক শুধু অর্থ-সম্পদের সঙ্গে। যার কাছে অর্থ-সম্পদ আছে, সে-ই শুধু সদকা করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে। যার কাছে নেই, তার সদকার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের কোনো ব্যবস্থা নেই; কিন্তু বিষয়টি আসলে এ রকম নয় ।
রাসুল (সা.)-এর বিভিন্ন হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, যারা অসচ্ছল, তাদের জন্যও সদকা করার রাস্তা খোলা আছে। সদকা মূলত দুই প্রকার : ১. অর্থ-সম্পদের মাধ্যমে সদকা । ২. আমলের মাধ্যমে সদকা । নিম্নে কোরআন-হাদিসের আলোকে আমলের মাধ্যমে সদকার ব্যাখ্যা দেওয়া হলো ।
আমলের মাধ্যমে সদকা : নিম্নে হাদিসে বর্ণিত দান না করেও আমলের মাধ্যমে দানের সওয়াব পাওয়া যায় এমন কিছু আমলের বর্ণনা উল্লেখ করা হয়
তাসবিহর আমল : আবু জার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.)-এর কিছুসংখ্যক সাহাবি তাঁর কাছে এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, ধন-সম্পদের মালিকরা তো সব সওয়াব নিয়ে নিচ্ছে। কেননা আমরা যেভাবে নামাজ আদায় করি, তারাও সেভাবে আদায় করে। আমরা যেভাবে সিয়াম পালন করি, তারাও সেভাবে সিয়াম পালন করে। কিন্তু তারা তাদের অতিরিক্ত সম্পদ দান করে সওয়াব লাভ করছে অথচ আমাদের পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা কি তোমাদের এমন কিছু দান করেননি, যা সদকা করে তোমরা সওয়াব পেতে পারো? আর তা হলো, প্রত্যেক তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ) একটি সদকা, প্রত্যেক তাকবির (আল্লাহু আকবার) একটি সদকা, প্রত্যেক তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) বলা একটি সদকা, প্রত্যেক ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা একটি সদকা । (মুসলিম, হাদিস : ২২১৯)
সৎ-কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বারণ : মানুষকে সৎ কাজের আহ্বান করা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য উৎসাহী করাও সদকা সমতুল্য। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক ভালো কাজের আদেশ দেওয়া এবং মন্দ কাজ করতে দেখলে নিষেধ করা ও বাধা দেওয়া একটি সদকা ।’ (মুসলিম, হাদিস : ২২১৯)
নম্র ব্যবহার : মহান আল্লাহ প্রতিটি পুণ্যের কাজকেই সদকা হিসেবে গণ্য করেন। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, প্রতিটি পুণ্যই দান-খয়রাতস্বরূপ। তোমার ভাইয়ের সঙ্গে তোমার হাসিমুখে সাক্ষাৎ এবং তোমার বালতি থেকে তোমার ভাইয়ের পাত্রে একটু পানি ঢেলে দেওয়াও সৎ কাজের অন্তর্ভুক্ত । (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৩০৪)
উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা বোঝা যায়, সদকা শুধু ধনাঢ্য ব্যক্তিদের আমল নয়, অসচ্ছল দরিদ্র ব্যক্তিরাও কিছু কিছু কাজের মাধ্যমে সদকার সওয়াব পেতে পারে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে ।
ইবাদতের ভরা বসন্ত রমজানে প্রতিটি ইবাদতদের মতো এর দান-সদকার সওয়াবও বেড়ে যায়। রমজানে মানুষের চাহিদা একটু বেড়ে যায়। কারণ সবাই চায় সারাদিন রোজা রেখে সন্ধ্যায় যেন একটু ভালো ভাবে ইফতার করতে পারেন। সাহরিতে তৃপ্তি সহকারে সামান্য খাবারের সংস্থান করতে পারেন। আমাদের চারপাশের অভাবী রোজাদারদের দিকে খেয়াল রাখা আমাদের অন্যতম বড় ইমানী দায়িত্ব। নিজেরা সামান্য কম খেয়ে হলেও প্রতিবেশীর চাহিদা পূরণ করা উচিত।
গরিব-দুঃখিদের জন্য সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে সওয়াব অর্জনের সর্বোত্তম সময় রমজান। অনেক গরিব-দুঃখি মানুষ আছেন যারা সাহরি ও ইফতারে সামান্য খাবারও জোগাড় করতে হিমশিম খায়। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় রমজানের সময় তাদের দুঃখ খানিকটা বেড়ে যায়। এ ধরণের মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রতিটি মুসলমানের ইমানী কর্তব্য।।
সদকা মানুষকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করে । মহানবী (সা.) বলেন, পানি যেমন আগুনকে নিভিয়ে দেয় নিশ্চয় তেমনি সদকা ও কবরের আজাবকে নিভিয়ে (বন্ধ করে) দেয়। (জামে তিরমিজি)
তাই তো রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, তোমরা খেজুরের সামান্য অংশ সদকা করে হলেও নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো। (সাহিহ বুখারি ও মুসলিম) কেউ যদি অভাবীদের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে, তা যত কম অথবা ছোটই হোক না কেন আল্লাহ তায়ালার কাছে তা খুবই প্রিয় । অভাবী মানুষকে খাবার প্রদান করা একটি উত্তম সদকা ।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, এক লোক নবীজি (সা.) কে প্রশ্ন করল, ‘ইসলামের কোন কাজটি উত্তম?’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘কাউকে খাবার খাওয়ানো…।’ (সহিহ বুখারি)
পক্ষান্তরে সামর্থ্যবান হওয়া সত্বেও যারা অভাবীদের জন্য খাবার পানীয় নিয়ে এগিয়ে আসবে না তাদের জন্য আল্লাহর দয়া সংকোচিত হয়ে আসবে। নবীজি (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না তার প্রতিও দয়া করা হয় না। (জামে তিরমিজি)।
অভাবী প্রতিবেশিকে ক্ষুধার্থ রেখে যে ব্যক্তি উদরপুর্তি করে খায় রাসুলে কারিম (সা.) তাকে কঠিন ভাষায় সতর্ক করেছেন। এমনকি ‘সে মুসলমান নয়’- এমন কঠিন ভাষাও তিনি প্রয়োগ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সেই ব্যক্তি মুমিন নয় যে তার প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্থ রেখেও পেট ভরে খায়।’ (সুনান আলকুবরা)
অনেকে গরিব ও অসহায়দের জন্য দান-সদকা করলেও পিতামাতা বা পরিবারের সদস্যদের জন্য খরচ করতে উদাসীনতা প্রদর্শন করেন। তাদের ধারণা হলো পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তানের জন্য খরচ করলে তো আর সওয়াব পাওয়া যাবে না। এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। মুমিনের পারিবারিক খরচও সদকা হিসেবে গণ্য হবে ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সওয়াবের আশায় কোনো মুসলিম যখন তার পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করে তা সদকা হিসেবে গণ্য হয় । (সহিহ মুসলিম)
অপর হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘একটি দিনার তুমি জিহাদের জন্য খরচ করেছ, একটি দিনার দাস মুক্তির জন্য ব্যয় করেছ, একটি দিনার একজন নিস্বকে দান করেছ এবং একটি দিনার নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করেছ। এগুলোর মধ্যে সওয়াবের দিক থেকে সর্বাধিক বড় হলো যা তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করেছ। (সহিহ মুসলিম)
আমাদের যাদের সামর্থ্য কম তারাও প্রতিবেশীদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারি। নিজের অপ্রয়োজনের খরচগুলো কমিয়ে, ধুমপানের মতো খারাপ অভ্যাসগুলো ছেড়ে দিয়ে তা দিয়ে জান্নাতের সদাইপাতি কিনতে পারি। তা দিয়ে একজন রোজাদারকে ইফতার করিয়ে লাভ করতে পারি পূর্ণ রোজার সওয়াব। আমার যে প্রতিবেশী বা আত্মীয়টি ইফতারের সংস্থান করতে পারে না, কারো কাছে হাতও পাততে পারে না আমাদের খরচ বাঁচিয়ে ২০০-৩০০টাকা দিয়ে তার ঘরে ইফতার পাঠাতে পারি । আমাদের পক্ষ থেকে পাঠানো এ ইফতার সামগ্রী বা খাদ্যদ্রব্য যদি কমও হয় তবু আল্লাহ তায়ালার কাছে তা খুবই প্রিয় হবে ।
রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করবে (আল্লাহর কাছে তা এতই প্রিয় হবে যে) আল্লাহ একে ডান হাতে কবুল করবেন। এরপর একে দাতার জন্য তোমাদের কারো অশ্বশাবককে প্রতিপালন করার মতো করবেন এবং প্রতিপালন করতে করতে পাহাড় পরিমাণ কড় করবেন (পাহাড় পরিমাণ দানের সওয়াব দান করবেন) । (সহিহবুখারি: ২/১০৮)
দান পরকালের কঠিন সময়ে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করে, ইহকালে প্রাচুর্যময় ও দুশ্চিন্তাহীন মর্যাদাপূর্ণ জীবন উপহার দেয়। আল্লাহ প্রদত্ত ধন-সম্পদ অভাবী ও অসহায় মানুষের জন্য ব্যয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ জনকল্যাণমূলক কাজে সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ অনেক সওয়াবের কাজ । এসব খাতে অর্থ-সম্পদ দানের মন-মানসিকতা গড়ে তোলা দরকার।
অতএব, প্রত্যেক বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিরই উচিত দুনিয়াতে বসেই পরকালের পুঁজি সংগ্রহ করা । দুনিয়ার চাকচিক্যে নিজেকে জড়িত না রেখে, ধন-সম্পদের মোহ ত্যাগ করে অন্ততপক্ষে আখেরাতের সাফল্যের জন্য প্রতিনিয়ত কিছু ব্যয় করা । আর আখেরাতের মিজানের পাল্লা ভারী করে আমলনামা ডান হাতে পাওয়ার প্রত্যাশায় হাদিসে বর্ণিত তিনটি কাজের পক্ষে যেকোনো একটি কাজ করে মউতের সুধা পান করা ।
সুতরাং, আমাদের সবার উচিত নিকটস্থ গরিব-দুঃখী, অসহায় এবং অভাবী আত্মীয়স্বজন কিংবা মাদরাসার এতিমখানায় বেশি বেশি দান সদকা করা । কেননা, দান-সদকায় বালা-মসিবত, বিপদ-আপদ দূর হয় ।
আল্লাহ ছোবাহানাহু তায়ালা, আমাদের এ দান-সদকার গুরুত্ব ও ফজিলত নিয়ে আলোচনার ওপর আমল করার তাওফীক দান করুক। আসুন আমরা সবাই আখেরী ও বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর বেশী বেশী দরুদ শরীফ পাঠ করি আল্লাহতায়ালা পেয়ারা হাবীরের মহব্বতের ফয়েজ আমাদের সকলের হৃদয়ে আসুক। আল্লাহুম্মা আমিন ।

লেখকঃ
এস এম ফখরুল ইসলাম নোমানী (মোরশেদ)
হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস
এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড